আত্নবিশ্বাসই একমাত্র সম্পদ যেটা আপনাকে সবসময় সাহস যোগাবে।

(Last Updated On: November 7, 2019)

অনেকেই দেখছি অল্পতেই ভেঙ্গে পড়েন। ১০১ টা অজুহাত খুজে বের করেন। তাদের জন্য আমার ব্যক্তিগত সংগ্রামের কিছু কথা শেয়ার করছি।

তখন ২০১২ সাল। আমাদের গ্রামাঞ্চলে অনলাইন, কম্পিউটার ব্যপারগুলি এতো বেশি প্রচলিত ছিলো না। আমি গ্রামীনফোনের ১৫ কেবিপিএস এর লাইন ব্যবহার করতাম। ভারতীয় বাংলা মুভির গান ডাউনলোড করে শুনাই ছিলো আমার প্রধান উদ্দেশ্য। যে কোন একভাবে আমি জানতে পারি যে অনলাইন থেকে আয় করা যায়। কম্পিউটার জগত্‌ ম্যাগাজিন থেকেই কয়েকজনের সাক্ষাতকার পড়ি। ব্যাপারটা আমার কাছে খু্ব ইন্টারেষ্টিং মনে হয়। ব্যাস সেই থেকেই ইচ্ছা জাগে। বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা বলতেই বাবা রাজী হয়ে যায়। শুরু হয় একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। ….

প্রথমে কেউ জানতো না। পরে যখন বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি, আত্নীয় স্বজন জানতে পারে যে আমি ঘরে বসে আয় করার স্বপ্ন দেখছি তখনই শুরু হয় গন্ডগোল। বাবা, মা ছাড়া আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না। বিশ্বাস করেন আমি কোথাও যেতে লজ্জা পেতাম। হাসি ঠাট্ট্রার পাত্রই হয়েছি বলা চলে। এক কথায় বলতে গেলে আমি একদিকে আর আমার পুরু সমাজ একদিকে। মানুষ মা কে নানান কথা বলতো। সেজন্য মা ও সকাল বিকাল আমাকে বোঝাতো আমি যেনো এইসব ছেড়ে দিয়ে টুকটাক টিউশনি করি আর পড়াশোনা করি।

২০১৩ সালের শেষের দিকে বাবাও সাপোর্ট দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কারন আমি ১ বছর পার হয়ে গেলেও কোন ইনকাম করতে পারছি না। এদিকে অনেকগুলি টাকাও খরচ হয়ে গেছে। সর্বশান্ত আমি! একটা কম্পিউটার ছিলো সেটাও বিক্রি করে দিয়েছি একটা কোর্স করার জন্য। আমার একটা বন্ধুর ধার করা ল্যাপটপে কাজ করতাম। এইবার বলতে পারেন আমি একদিকে আর পুরু পৃথিবী একদিকে। বাবা মা সিদ্ভান্ত নিলো, আমাকে আর তারা ল্যাপটপ ধরতেই দিবে না। সেইদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেক কেদেছিলাম ও। কারন আমি ল্যাপটপ ছাড়া থাকতে পারতাম না। অনেক বুঝেয়ে বাবা মাকে রাজী করালাম যেনো তারা ল্যাপটপটাও কেড়ে না নেয়। সেইদিন বসে টিউটোরিয়াল দেখছি আর কান্না করছি। কীবোর্ডগুলি ভিজে গিয়েছিলো।

তেমনভাবে আড্ডা দিতাম না বললেই চলে। তার পরেও আমার গ্রামের কিছু বন্ধুবান্ধব এর সাথে যখন সময় কাটাতাম তখন আমি ল্যাপটপ নিয়ে যেতাম। তারা টিভি দেখতো আর আমি ল্যাপটপে কাজ করতাম। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো ইন্টারনেট। আমাদের বাসার পাশে একটা পাঁচতলা বিল্ডিং আছে। যারা আমার কাছের মানুষ তারা নিশ্চই দেখেছে কতটা সংগ্রাম করতাম ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য।

যখন পুরু পৃথিবী আমার বিপক্ষে তখন আমি একটা চ্যালেঞ্জ এর উপর দিয়ে দিন পার করতাম। ভাবতাম বিখ্যাত মানুষদের বিখ্যাত হওয়ার পেছনে নাকি তাদের ভালোবাসার মানুষের অনুপ্রেরনা কাজ করে। মূলত সে ভাবনা থেকেই একজনকে ভালোবেসে বেশ ভালো সময় দেই। চেয়েছিলাম হয়তো সে আমাকে অনুপ্রেরনা দিবে যা আমাকে হতাশা থেকে মুক্তি দেবে। হায় আল্লাহ! তার বলা কিছু উক্তি বলছি: ***”তুই এই কম্পিউটার ছাইড়া অন্য কোন কাজ করন কম্পিউটার দিয়ে যে কে কি করেছে তা আমার ভালো করেই জানা আছে”, ***”আচ্ছা তুই এই কম্পিউটার নিয়ে পইড়া থাইকা কি প্রমান করতে চাস?”, ***”তুই মনে রাখিস, এ কম্পিউটার ই তোর জীবনের কাল হয়ে দাড়াবে”। আরো কতো কি!!! মূলত সবচেয়ে বড় হতাশা আর কষ্ঠটা পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে। এই কথাগুলি যদি তুমি করে বলতো তাও না হয় কষ্ঠটা কম পাইতাম।

ইন্টারনেটের কথা বলতেই হয়। আহা! সে যে কি কষ্ঠ! গ্রামে থাকি বলে আরো বেশি কষ্ঠ হতো। কোন উপায় ই নাই। থ্রিজি আসার আগে টুজি ব্যবহার করতাম। তারও আগে সিটিসেল জুম ব্যবহার করতাম। মাসিক খরচ ছিলো ২৫০০+ টাকা। এভাবেই দিন পার করতাম। সবচেয়ে বেশি কষ্ঠ পেয়েছিলাম ইন্টারনেট নিয়ে। অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলাম ব্রডব্যান্ড এর জন্য। কিন্তু গ্রামে থাকি বলে তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয় নি।

সহজ কথায় বলতে গেলে পৃথিবী আমার বিপক্ষে আর আমি একদিকে। আমার সঙ্গী শুধু আমার আত্ববিশ্বাস, আমার প্যাশন, আমার স্বপ্ন, আমার ভালোলাগা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি প্রায়। ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত বেচে থেকেও মরা মানুষের মতো। কারো কোন সাপোর্ট নাই। সম্বল হিসাবে ছিলো শুধু বন্ধুর একটা ল্যাপটপ। মানুষের বাবা মায়েরা তাদের ছেলেদের বলতো, “আর যাই করোস, শাকিলের মতো এমনভাবে আজাইরা কাজে জীবনটাকে নষ্ট করিস না”। আমার মা আমাকে প্রায়ই এসব বলতো। আমি খুব কষ্ঠ পেতাম। এভাবেই ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত সময়টা অতিবাহিত হয়েছিলো।

এতো কিছুর পরেও আমার মূল লাইন থেকে আমি এতটুকু ছিটকে পড়িনি। ঘুমানো ছাড়া ১৬ ঘন্টা লাপটপ নিয়ে পড়ে থাকতাম। অপমান, অবহেলা এইসব গায়ে মেখে নিয়েছি। তখন আর খারাপ লাগতো না।

এখন ২০১৭ সালের মে মাস। এই লেখাটি আমি আমার ম্যাকবুকের ল্যাটেষ্ট ভার্সন থেকে লিখছি। দুয়েল মনিটর ওয়ালা একটা ডেক্সটপ ও আরো একটা ব্যাকআপ ল্যাপটপ আছে। ঐ যে বন্ধুর ল্যাপটপটা মনে আছে? ঐটা আমি পরে কিনে নিয়েছিলাম। আমার বাসায় সর্বমোট ৩ টা ইন্টারনেট কানেকশন। একটা ক্যাবলের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড, আর একটা এয়ারের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড, আর একটা গ্রামীনফোনের দেড় জিবি প্যাকেজের ব্যাকআপ ইন্টারনেট। আইপিএস ব্যাক আপ দেয় ১২ ঘন্টা সে হিসাবে বিদ্যুত্‌ নিয়ে সমস্যা নাই। বেশি গরম লাগলে এসি ছাইড়া বইসা থাকি। বোরিং ফিল হলে PS4 Pro তে ভাইস সিটি গেম খেলি। একঘেমিয়ে লাগলে বাইক ও ডিএসএলআর নিয়ে আমার এক ভাতিজাকে নিয়ে ঘুরতে বের হই। মাঝে মাঝে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে RC Racing Car চালাই। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যখন খুশি তখন শপিং করি। গত বছরে ইন্ডিয়া, মালৈশিয়া ও সিঙ্গাপুর ভ্রমন করেছিলাম। এইবার ইউরোপে ভ্রমনের ইচ্ছা আছে। বাবা আগে বিদেশে ছিলো। এখন তিনি পুরুপুরি রেষ্ট এ আছে। আমি ই কোন কাজ করতে দেই না। ব্যাংকে গেলে ভিআইপি গ্রাহক হিসাবে সস্মান পাই। আমাদের গ্রামের মধ্যে আমার বৃহত্‌ পরিবার ই একমাত্র পরিবার যাদের প্রত্যেকের ঘরে একটা করে ল্যাপটপ আছে। সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আমি সত্যিই গর্বিত। আমি এমনটাই চেয়েছিলাম।

সবচেয়ে ভালো লাগার পার্ট হচ্ছে যে, শুনতে পেরেছি আমাকে দেখে অনেকে অনলাইনের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এখানে সেখানে আলোচনা হয়। বাবা মা নাকি তাদের সন্তানদের বলে, “যদি পারোস শাকিলের মতো কিছু একটা কর। শাকিলকে দেখে শিখ কিভাবে জীবনে কষ্ঠ করে সফল হতে হয়। পোলাডা গ্রামে থেকেও কতকিছু করেছে”। অনেকে নাকি আমাকে আইডল হিসাবে নেয়। হেটাররাও চুপসে গেছে। তারাও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।

YES! I am the king of my own kingdom. <3 <3 <3